অন্তত ডজনখানেক দেশে নিজেদের সামরিক লজিস্টিক সুবিধা জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। এর মধ্যে তিনটি দেশ বর্তমানে চীনের অন্যতম ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারতের প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের এ তোড়জোড়ের উদ্দেশ্য হলো দেশটির সেনাবাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) যেন চীনা ভূখণ্ড থেকে বহুদূরেও তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারে, তার বন্দোবস্ত করা। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। খবর ইকোনমিক টাইমস।
পেন্টাগনের ওই প্রতিবেদনে ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মিয়ানমার ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কেনিয়া, সিসিলিস, তানজানিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও তাজিকিস্তানের নাম রয়েছে। এসব দেশে নিজেদের সামরিক লজিস্টিকস বেজ স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বেইজিং।
গত মঙ্গলবার ‘মিলিটারি অ্যান্ড সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টস ইনভলভিং দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) ২০২০’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পেন্টাগন। প্রতিবেদনটি মার্কিন কংগ্রেসে জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলেছে, জিবুতির পাশাপাশি উল্লিখিত দেশগুলোয়ও মিলিটারি বেজ স্থাপনের ছক আঁকছে চীন। জিবুতির ওই সামরিক ঘাঁটি স্থল, নৌ ও বিমানসেনাদের সহায়তার জন্য স্থাপন করেছে শি জিনপিং প্রশাসন।
পেন্টাগনের প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পিএলএ যে মিলিটারি লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে, তাতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের আগ্রাসী কার্যক্রমে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে।’
পেন্টাগন ধারণা করছে, চীন হয়তো এরই মধ্যে নামিবিয়া, ভানুয়াতু ও সলোমন দ্বীপে তাদের সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছে। পিএলএ যেসব এলাকাকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছে, সেগুলো মূলত চীন থেকে হরমুজ প্রণালি পর্যন্ত বিস্তৃত সি লাইনস অব কমিউনিকেশনের নিকটবর্তী, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, বেইজিং তাদের পরিসীমার কাছাকাছি ও দূরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সংহতি বাড়াতে চাইছে। আর এ কাজে তারা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) উদ্যোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানে পাইপলাইন ও বন্দর নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট ওবিওআর প্রকল্পগুলো চীন এ কারণে বাস্তবায়ন করছে, যেন জ্বালানি সম্পদ পরিবহনের ক্ষেত্রে কিছু কৌশলগত চেকপয়েন্টের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে যায়। এ ধরনের একটি চেকপয়েন্ট হলো মালাক্কা প্রণালি।’
চীন প্রথম ওবিওআর উদ্যোগের ঘোষণা দেয় ২০১৩ সালে। এটি শি জিনপিং প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
পেন্টাগন বলছে, ওই সব সামরিক ঘাঁটিতে চীনা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আশ্রয়দাতা দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতে পারে। কারণ চীনা কর্মকর্তারা এটি ভালোভাবেই অনুধাবন করছেন যে তাদের এ মিলিটারি লজিস্টিকস বেজ স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আশ্রয়দাতা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুব জরুরি।
চীনের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য দেশের ভূখণ্ডে এ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ফলে চীনা সেনাবাহিনীর প্রতিপত্তি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গতি পাবে। এছাড়া কূটনৈতিক বিষয়ে নিজ দেশে পূর্বানুমান পাঠানো, অন্য দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করা, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনেও ভূমিকা রাখবে এটি। তারা আরো বলেছেন, মিলিটারি লজিস্টিক নেটওয়ার্ক স্থাপনের ফলে মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর গোয়েন্দা নজরদারির সুযোগ পাবে চীন।
২০১৭ সালের আগস্টে আফ্রিকার জিবুতিতে নিজেদের প্রথম সামরিক ঘাঁটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে চীন। চীনা নৌবাহিনীর মেরিন সেনারা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছেন। তাদের কাছে সশস্ত্র সামরিক যান ও আর্টিলারি রয়েছে। কিন্তু নিজস্ব জেটি না থাকায় বর্তমানে তাদের নিকটবর্তী বাণিজ্যিক বন্দরের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে।
জিবুতির ওই ঘাঁটি থেকে চীনা সামরিক কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটের ওপর নজরদারি চালান। এছাড়া ওই ঘাঁটির ওপরের আকাশসীমায় অন্য কারো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থাও করে নিয়েছে তারা।
পেন্টাগন বলছে, পিএলএ অনেকগুলো দেশেই নিজেদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাদের মধ্যে কয়েকটি দেশ বেইজিংয়ের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে পারে বলে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে।