পাহাড়ের উপত্যকায় পা রাখা মাত্রই রুদ্র মূর্তিতে ঘিরে ধরেছিল ভারতের বাহিনী। যুদ্ধট্যাঙ্কের অবস্থানও টের পাওয়ানো হয়েছিল সুকৌশলেই। কোনওরকম প্রাণহানি না ঘটিয়েই চিনের বাহিনীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রাতের আঁধারেও কী ভীষণ প্রত্যাঘাত হানতে পারে ভারতের ফৌজ।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২৮ অগস্ট রাতে চুপিসারে দক্ষিণ প্যাঙ্গং হ্রদ সংলগ্ন হেলমেট পাহাড়ি এলাকার দিকে যখন পা বাড়িয়েছিল চিনের সেনা, তারা জানতই না কতটা প্রস্তুতি নিয়ে আগে থেকেই ঘাপটি মেরে আছে ভারতের দুর্দান্ত স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। চুসুল রেজিমেন্টে ভারতের ভীষ্ম ট্যাঙ্কের নলও যে চিনের বাহিনীর দিকেই তাক করা ছিল, সে খবরও ছিল না তাদের কাছে। নেহাত আত্মগর্বে বলীয়ান হয়েই ভারতের ভূখণ্ডে তাদের জমি দখলের চেষ্টা করেছিল লাল ফৌজ। মোক্ষম ধাক্কাটা তাই এসেছিল শুরুতেই।
পাহাড়ের উপত্যকায় পা রাখা মাত্রই রুদ্র মূর্তিতে ঘিরে ধরেছিল ভারতের বাহিনী। যুদ্ধট্যাঙ্কের অবস্থানও টের পাওয়ানো হয়েছিল সুকৌশলেই। কোনওরকম প্রাণহানি না ঘটিয়েই চিনের বাহিনীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রাতের আঁধারেও কী ভীষণ প্রত্যাঘাত হানতে পারে ভারতের ফৌজ। সামরিক অস্ত্রও গর্জে উঠে নিমেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে তাদের যাবতীয় পরিকাঠামো। ঠিক যেভাবে চুপি চুপি ভারতের ভূখণ্ডের দিকে পা বাড়িয়েছিল চিন, ততটাই নিশ্চুপে পিঠটান দিয়েছিল তারা। হাজারের বেশি লাল সেনা কোনওরকম আস্ফালন না দেখিয়েই মুখ বুজে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
Here’s A Peek Into India’s Secretive Special Frontier Force Raised In 1962 To Counter The Chinese
ভারতীয় সেনা সূত্র পরে জানিয়েছিল, এই অপমান বিশেষ ধাতে সয়নি চিনের বাহিনীর। তাই ফিরে গিয়ে তারা দাবি করেছিল, ভারতের বাহিনীই আগ্রাসন দেখানোর চেষ্টা করেছে। মোদ্দা কথা হল, প্যাঙ্গং রেঞ্জের যে এলাকায় নতুন করে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করেছিল লাল ফৌজ সেই এলাকা ভারতীয় সেনার নিয়ন্ত্রণেই থাকে। স্প্যানগুর গ্যাপের কাছ ঘেঁষা রেচিন লা, রেজাং লা হয়ে সোজা মলডো, ক্যামেল’স ব্যাক, কালা টপ ও হেলমেট এই সমস্ত পাহাড়ি এলাকায় ইন্দো-তিব্বতি সেনারাই টহল দেয়। চিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পরে তাই উঁচু পাহাড়গুলোর ওপর অস্ত্র নিয়ে সতর্ক নজর রেখে বসে আছে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মাউন্টেন ফোর্স স্পেশাল ফ্রন্টিয়ারের কম্যান্ডোরা।
আরও পড়ুন: চিনের যম ভারতের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পাওয়া বাহিনীই ঘুম উড়িয়েছে লাল ফৌজের
Indian Army beats Chinese troops, occupies strategic height near Pangong lake’s southern bank: Sources –
এখন প্রশ্ন হল চিনের বাহিনী যে প্যাঙ্গং হ্রদের দক্ষিণে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করবে সেটা টের পাওয়া গেল কীভাবে। ভারতীয় সেনারা জানাচ্ছে, প্রথমত, ১৫ জুন গালওয়ানের সংঘাতের পরেই সতর্ক হয়ে যায় ভারতের বাহিনী। কারণ গালওয়ানের ১৪ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্টে নিজেদের ক্যাম্প খাটাতে না পেরে চিনের সেনা প্যাঙ্গং হ্রদ সংলগ্ন গ্রিন টপে ঢুকে পড়েছিল। এই গ্রিন টপ হল প্যাঙ্গং লেকের উত্তরে সবুজে ঢাকা উপত্যকা। প্রায় ৫০০০ মিটার বিস্তৃত এই উপত্যকা থেকে চিন তার সেনা সরাতে রাজি হয়নি। দুই দেশের সেনা কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের পরেও। তাই তখন থেকেই নতুন কৌশল ঠিক করে ফেলে ভারতের বাহিনী।
আরও পড়ুন: উর্দি নেই তবু সেনা, প্যাঙ্গংয়ের কালা পাহাড়ে ভারতীয় জওয়ানদের খাবার, জল পৌঁছে দিচ্ছেন চুসুল গ্রামের বাসিন্দারা
In China’s troop movements in Ladakh’s depth areas, a hint about its real plan – india news – Hindustan Times
ভারতের জওয়ানরা বুঝেছিলেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গালওয়ান, গোগরা, হট স্প্রিং ও দেপসাং সমতলভূমিতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলেও আস্ফালন দেখানোর চেষ্টা করবে লাল ফৌজ। কিন্তু তলে তলে তাদের লক্ষ্য হবে প্যাঙ্গং হ্রদের দুই তীরের পাহাড়ি এলাকা। কারণ এই এলাকা থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণে অঞ্চলের পিএলএ ক্যাম্প ও ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট কাছাকাছি পড়ে। তাছাড়া শীতের আগে পাহাড়ি এলাকার দখল নিতে পারলে ভারতের বাহিনীকে সেইসব অঞ্চলে টহল দেওয়া থেকে আটকানো যাবে। মজার ব্যাপার হল, চিনের মনোভাব যে ভারত অনেক আগে থেকেই আঁচ করেছিল সেটা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
সেনা সূত্র জানাচ্ছে, মে মাস থেকেই প্যাঙ্গং রেঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। কারণ শীতের আগে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও আঁটোসাঁটো করার প্রয়োজন পড়ে। জুনের সংঘাতের পরে একটু একটু করে দক্ষিণ ও উত্তর প্যাঙ্গং এলাকায় তৈরি হচ্ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। এই বাহিনী গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। যে কোনও পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় যুদ্ধ করার মতো ক্ষমতা ও দক্ষতা দুই আছে এসএফএফ কম্যান্ডোদের। ইনটেলিজেন্স ব্যুরো ও ‘র’-এর থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়ায় শত্রুপক্ষের মনোভাব আঁচ করে রণকৌশল ঠিক করার দক্ষতাও আছে এই বাহিনীর। দক্ষিণ প্যাঙ্গংয়ে তাই এসএফএফ কম্যান্ডোদেরই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। তাছাড়াও ওই এলাকায় বসানো হয়েছিল স্পেশাল সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা। এই ক্যামেরাতেই ধরা পড়ে চিনের বাহিনী তাদের ক্যাম্পে তৎপর হয়ে উঠেছে। চেপুজি ক্যাম্প থেকে যখন আর্মড ভেহিকল নিয়ে রওনা দিয়েছিল লাল ফৌজ সেটাও ধরা পড়েছিল এই সার্ভিল্যান্স ক্যামেরাতেই। তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন কম্যান্ডোরা।
Ladakh Stand-Off: How India will counter PLA’s tanks – Rediff.com India News
ভারতীয় সেনা সূত্র আরও জানাচ্ছে, দক্ষিণ প্যাঙ্গংয়ে ঢোকার আগে তিব্বতের কাছে হোটান বায়ুসেনা ঘাঁটিতে চিনের যুদ্ধবিমান ওঠানামা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। হোটান এয়ারবেস রয়েছে চিনের শিংজিয়াং প্রদেশে যা পূর্ব লাদাখের কাছাকাছি। এখান থেকে বোমারু বিমানও সীমান্তের কাছে মোতায়েন করেছে চিন। দিনকয়েক ধরেই চিনের পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ যুদ্ধবিমানকে প্যাঙ্গং এলাকায় চক্কর কাটতে দেখা যায়। হোটান এয়ারবেসের টারম্যাকে দুটি জে-২০ ফাইটার জেটকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গিয়েছিল। চিনের বাহিনী যে নতুন করে অশান্তি বাঁধাতে পারে সেই আঁচ তখনই করেছিল ভারতের সেনাবাহিনী। একদিকে পাহাড়ি এলাকায় এসএফএফ কম্যান্ডোদের প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, অন্যদিকে চুসুলে টি-৯০ ভীষ্ম ও টি-৭২ যুদ্ধ ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছিল ভারত। চিনের সেনা কোনওভাবে ঢুকে পড়লে তাদের সামরিক বহর উড়িয়ে দিত ভারতের যুদ্ধট্যাঙ্ক। অন্যদিকে, জওয়ানদের হাতে দেওয়া হয়েছিল ইগলা মিসাইল সিস্টেম। এই মিসাইল সিস্টেম যা কাঁধে নিয়ে নিপুণ নিশানায় শত্রুপক্ষের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা যায়। ভারতের কৌশল দেখে তাই জমি দখলের আশা ছেড়েই পিছু হটেছিল চিনের লাল ফৌজ।