ল’কডা’উন ও অন্য পথে যাওয়া একটি মেয়ে

ল’ক’ডাউনে অনলাইন ভিডিও চ্যা’টিং করছে শোভা। এটা নিয়ে সকাল থেকে তার পাঁচ নম্বর ভিডিও কল। শোভা মানে শোভা মাঝি, সোনাগাছির নীলকমলের একজন প’তিতা, যার এ তল্লাটের পনেরো হাজার মেয়েদের মতই জীবিকা বিপ’ন্ন ল’ক’ডাউনের জেরে।

একটাও খ’দ্দের নেই এই চৌত্রিশ দিন। কিভাবে যে দিন চলছে! বাড়ি ভাড়া, খাওয়া খরচা, বাড়িতে বাবা মাকে টাকা পাঠানো – সব দায়িত্ব তার। সরকারি কিছু সাহায্য পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু দরকারের তুলনায় তা অপ্রতুল।

শেষে বুদ্ধি খাটিয়ে দা’লালরাই একটা উপায় বের করেছে – মেয়েরা অনলাইন এ’ডাল্ট চ্যাটিং করবে খ’দ্দেরদের সঙ্গে, পরিবর্তে তাদের মেয়েদের একাউন্টে অনলাইন টাকা ট্রান্সফার করতে হবে। মেয়েদের ভিডিও চ্যা’টিং করতে হবে বি’ব’স্ত্র হয়ে, খ’দ্দেরদের চা’হিদা অনুযায়ী শ’রীরের অংশ বিশেষ দেখাতে হবে ক্যা’মেরায়। দালালরা থার্টি পার্সেন্ট পাচ্ছে এই নতুন বন্দোবস্তে।

ফোনের ও প্রান্তে যিনি, তিনি মাঝবয়স্ক, ব্যবসায়ী ট্যাবসায়ী হবেন বোধহয়, প্রেমের পাক্কা নাগর। তার একেকটা আবদারে শোভারই কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু খ’দ্দের ল’ক্ষ্মী, তাই মনের বিরক্তি মনে চেপে রেখেই খ’রিদ্দারের সঙ্গে অ’ন’স্ক্রী’ন ঢলাঢলি করতে লাগলো শোভা ।

পনেরো মিনিটের চ্যা’টিং স্ল’ট শেষ হতে চললো। বয়স্ক খ’রিদ্দার বললেন যে তিনি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন, আবার কয়েকদিনের মধ্যে তার কাছে আসবেন । সম্মতি জানিয়ে শোভা লাইন কেটে দিল।

পাঁচটা স্ল’ট, পাঁচ হাজার টাকা রোজগার হয়েছে। হারু দা’লা’লকে দেড় হাজার একাউন্ট ট্রান্সফার করতে হবে আজই, বাবার একাউন্টে দু’হাজার দিতে হবে । মা’র প্রে’শার, সুগারের ওষুধ অনেক দিন ধরে বন্ধ।

বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিংয়ের সোফায় বসলো শোভা। নিজেকে খুব হাল্কা লাগছিল শোভার। যাক, হাতে কিছু টাকা পাওয়া গেল। কাল, পরশু আবার কল আছে।

অদ্ভুত লাগে শোভার – দেশে যখন মড়ক লেগেছে, সবাই ঘরবন্দী, গরীবদের কাজ নেই, অন্নের হাহাকার, চারিদিকে মৃ’ত্যুর ভ’য়, তখন মুষ্টিমেয় এইসব লোকেদের মাথায় এত মি’লনের চিন্তা ঘোরে কি করে?

এইসব লোকজনদের জন্যই তো দেশে মেয়েদের ওপর এত অ’ত্যা’চার, এত রে’প। শোভার হঠাৎ মনে পড়ে যায়, যেদিন নি’র্ভয়ার রে’প কারীদের ফাঁ’সি হলো – রাস্তায় বেরিয়ে এসে আনন্দে নেচেছিল সে।

কেন রে বাবা, নিরপরাধ, ভালোমানুষ মেয়েগুলোকে রে’প করা, খু’ন করা ! কে তোদের লাইসেন্স টু রে’প এ’ন্ড কি’ল দিয়েছে ? এত চুলকানি যখন, যা না প’তিতালয়, কিছু কড়ি ফেলে ফূর্তি কর গে যা না। কেন ভালো মানুষ মেয়েগুলোকে বরবাদ করা ?

প’তিতা শব্দটা মাথাযর ভিতর উচ্চারিত হতেই শোভার মনে পড়লো সে নিজেও তো তাই। সেই কবে তার প্রেমিক তাকে ফুসলে, বিয়ের লোভ দেখিয়ে এখানে বিক্রী করে দিয়েছিল।

তারপর থেকে সে এই ন’রকে পড়ে আছে, যৌ’ন ক’র্মী হয়ে। বাড়ীতে তাকে নেয় না কেউ, কিন্তু বৃদ্ধ অসহায় বাবা মা’র খোরাকি খরচ, ওষুধের খরচ সে নিয়মিত পাঠিয়ে দেয়।

কারণ সে জানে বাবা মা তাকে বর্জন করলেও, তার সাপোর্ট ছাড়া তাঁরা বেশীদিন বাঁ’চতে পারবেন না, আর এটা করতে গিয়ে তার প্রায়ই মনে হয় তার কৃ’তক’র্মের কিছুটা পা’প স্খ’লন হচ্ছে ।

হঠাৎই শোভার মনে হলো সে তার পেশাকে পা’পই বা ভাববে কেন ? আর পাঁচটা পেশার মত এটাও তো একটা পেশা । হতে পারে এই পেশায় সে অনিচ্ছায় জড়িয়েছে । কোন জোরাজুরি নেই, খ’দ্দেররা স্বেচ্ছায় আসছে, সার্ভিস নিচ্ছে, বিনিময়ে পয়সা দিচ্ছে। আর সেই পয়সা দিয়ে তিনটে লোকের পেট তো চলছে।

আজ তার নিজেকে একজন অসংগঠিত সে’ক্টরের মজদুর বলে মনে হচ্ছে – কোটি কোটি ‘দিন আনি, দিন খাই’ ভারতবাসীর সঙ্গে তার তফাৎটা কোথায় ?

করোনার জন্য লক্ষ কোটি দিন মজুর, ক্ষেত মজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ছোট দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাজ হারিয়ে চরম কষ্ট সহ্য করে গৃহবন্দী, ঠিকমত খাওয়া জুটছে না তাদের, ভিন রাজ্যে আটকে পড়া মজুর, শ্রমিকরা চরম বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখে – তখন একই কারণে তাদের মত মেয়েরাও কর্মহীন।

ডেলি লে’বাররা, মিস্ত্রীরা, ছোট দোকানদাররা কাজ খুইয়ে ভ্যানে করে শাক সব্জি,মাছ বেচছে শুধু মাত্র আপতকালীন বেঁচে থাকার জন্য। আর আজ সে যে কাজটা করলো, সেটাও তো তিনটে প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যই ।

কন্ঠনালীর কাছে গ্লানির একটা অস্বস্তি এতক্ষণ দলা পাকিয়ে ছিল, সেটা যেন আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে শোভার। দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। নি’র্ঘাত হারু এসেছে।

ওর কমিশনটা এখুনি ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে দিতে হবে। তারপর বাবার একাউন্টেও টাকা পাঠিয়ে তাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে। নিজের অজান্তে চোখের কোণে জমে ওঠা জল আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছে ঘরের দরজা খুলতে গেল শোভা ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.